বাগেরহাট প্রতিনিধিঃ
আজ থেকে শুরু হচ্ছে সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকি মৌসুম। দুবলার চরের শুঁটকি পল্লিতে শুরু হবে কর্মব্যস্ততা। তবে গত শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) দিনগত রাত ১২টার পরপরই দুবলার চরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন অনেক জেলে।
অনেক জেলেই চড়া সুদে টাকা নিচ্ছেন সুদের কারবারিদের কাছ থেকে। কেউবা টাকা গ্রহণে এনজিও, বিভিন্ন ব্যাংক ও সমিতি থেকে ঋণ করছেন।ঋণ, সুদের বোঝার সঙ্গে এমন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই ৫ মাসের এক অনিশ্চিত জীবন শুরু করতে চলছে এসব জেলের প্রস্তুতি।
বনবিভাগ জানায়, ১লা নভেম্বর থেকে শুঁটকি আহরণ মৌসুমে বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষা সুন্দরবনের দুবলার চারটি চরে দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় ১০ হাজার জেলে অবস্থান করবেন। সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করে সুন্দরবনের চরে নিয়ে এসে শুঁটকি তৈরি করবেন তাঁরা।
তাই শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততায় উপকূলের জেলে-মহাজনেরা। সাগরে যেতে যে যার মত প্রস্তুত করছেন জাল, দড়ি, নৌকা-ট্রলার। কেউ কেউ গড়েছেন নতুন ট্রলার, আবার কেউ পুরাতনটিকে মেরামত করে নিয়েছেন। সাগরে যাওয়ার শেষ প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি তারা।
বনবিভাগের পাস নিয়েই তারা রওনা হয়েছেন সাগর পাড়ের দুবলার চরে। সাগরে এখন আর দস্যুদের উৎপাত না থাকলেও ঝড়-জলোচ্ছাসের প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি মাথায় নিয়েই দুবলায় যাত্রা শুরু করবেন হাজার হাজার জেলে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ সুত্রে জানাগেছে, সমুদ্রে মৎস্য আহরন ও শুটকি মৌসুমকে ঘিরে এবছরও প্রায় ১০ হাজার জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী জড়ো হবে বঙ্গোপসাগর উপকুল বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের দুবলাসহ ৪ টি চরে। ৫ মাস ব্যাপী চলবে এ শুটকি আহরন মৌসুম।
বনবিভাগ সুত্রে আরো জানা যায়, বঙ্গোপসাগর পাড়ে সুন্দরবনের দুবলার চরে ২৯ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এ মৌসুম চলবে আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত। টানা ৫ মাস সেখানে থাকতে হবে জেলেদের। তাই সাগর পাড়ে গড়তে হবে তাদের অস্থায়ী থাকার ঘর, মাছ শুকানো চাতাল ও মাচা।
সেসব তৈরিতে ব্যবহার করা যাবেনা সুন্দরবনের কোন গাছপালা-লতাপাতা। তাই বনবিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী চরের উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নেয়া সকল জেলে তাদের ট্রলারে করে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী। আর এ সকল প্রস্তুতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগেরহাটসহ উপকূলের কয়েক জেলার জেলে-মহাজনেরা।
দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের নেতা কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনে এখন আর দস্যুতার ভয় নেই। তাই অনেকটা স্বস্তি নিয়েই সাগরে যান জেলেরা। তবে বনবিভাগ থেকে এখনো সব পাস পারমিট পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও জানান, শুঁটকি মৌসুমকে ঘিরে এবারও উপকূলের বিভিন্ন এলাকার সাড়ে ছয় হাজার বহরদারের অধীনে প্রায় ৯-১০ হাজার জেলে সমবেত হবেন দুবলার চরে। ট্রলার নিয়ে গভীর সাগর থেকে আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বাছাই করে শুঁটকি করবেন তারা। বনবিভাগের কাছ থেকে পাস নিয়ে আজ থেকে তারা সাগরে যেতে শুরু করবেন।
সমুদ্রগামী জেলে সমিতির সভাপতি মল্লিক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিকল্প কোনো কাজের সুযোগ না থাকায় ধারদেনা করে হলেও শুঁটকি আহরণের এই অনিশ্চিত যাত্রায় ছুটতে হয় জেলেদের। শুঁটকি থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব পায় সরকার। তবে সব থেকে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন চরে মহাজনদের কাছে মাছ বিক্রিতে আমরা সঠিক মূল্য পাই না।’
সুন্দরবন অভ্যন্তরে কমপক্ষে ১৫ টি মৎস্য আহরণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ কেন্দ্র নিয়ে এই দুবলা জেলে পল্লী । দুবলা জেলে পল্লীর জেলেরা নিজেদের থাকা, মাছ ধরার সরঞ্জাম রাখা ও শুটকী তৈরির জন্য প্রতি বছর অস্থায়ী ঘর ও মাচা তৈরি করে থাকে। জেলেরা সমুদ্র মোহনায় বেহুন্দীসহ বিভিন্ন প্রকার জাল দিয়ে মাছ শিকার করে তা বাছাই করে জাত ওয়ারী মাছগুলো শুটকী করে থাকে। জেলে পল্লীতে জেলেদের ঘর তৈরি ও জ্বালানি ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত রাজস্ব আদায় করে থাকে সুন্দরবন বন বিভাগের দুবলা টহল ফাঁড়ি।
মৌসুমের শুরুতেই দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকুলের হাজার হাজার জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা সুন্দরবন সংলগ্ন দুবলার চরাঞ্চালে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া,ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বনদস্যুদের উৎপাতের মধ্যেও জীবন -জীবীকার তাগিদে সাগর পাড়ের চরাঞ্চালে পৌছাতে সব প্রস্তুতি শেষ করেছ তারা।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা সহকারী বন সংরক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম হাওলাদার জানান, বনবিভাগের কাছ থেকে পাস (অনুমতিপত্র) নিয়ে নিজ নিজ এলাকা থেকে রওনা হয়ে জেলেদেরকে সরাসরি যেতে হবে দুবলার চরে। যাওয়ার পথে সুন্দরবনের কোন নদী-খালে প্রবেশ ও অবস্থান করতে পারবেন না সমুদ্রগামী এ জেলেরা। এছাড়া দুবলার চরে অবস্থানকালে সাগর ছাড়া সুন্দরবনের খালে প্রবেশ ও সেখানে মাছ ধরতে পারবেন না বলেও তিনি জানান।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, এ বছরও চরে জেলেদের থাকা ও শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য এক হাজার ৩০টি ঘর, ৬৩টি ডিপো এবং ৯৬টি দোকান স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গত শুঁটকির মৌসুমে দুবলার চর থেকে বনবিভাগের রাজস্ব আদায় হয়েছিল তিন কোটি ৮৫ লাখ ৩৭ হাজার ১৯৮ টাকা। এবারও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে তার চেয়েও বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।
Leave a Reply