এম এ হালিম শ্যামনগর থেকেঃ
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বারসিক আয়োজিত ১৮-২১ মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত ৪ দিন ব্যাপি যুব জলবায়ু কর্মশালায় রাজশাহী, নেত্রকোণা, মানিকগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও ঢাকার ৫০ তরুণ ৬ টি ইউনিয়নের ৬টি গ্রাম ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ পরিদর্শন করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও স্থানীয় অভিযোজন বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিয়ে উপকূলের সংগ্রামী জীবনের সাথে সংহতি জানালেন।
নেত্রকোণার কলমাকান্দার লেঙ্গুরা গ্রামের মেয়ে সুস্মিতা হাজংদের এলাকা প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলে আক্রান্ত হয়। পাহাড়ের বালিতে নষ্ট হয় ফসলের জমি, বাড়ছে পানি সংকট। রাজশাহীর তানোরের মুন্ডুমালার মেয়ে আইরিন হেমব্রমের গ্রামে পানির খুব অভাব। অনাবৃষ্টি আর খরার প্রতিবছর নষ্ট হয় ফসলের জমি। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের ‘চর জলবায়ু স্বেচ্ছাসেবক টিমের’ সদস্য ফয়সাল হোসেনদের চরে নদীভাঙন বাড়ছে। মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, নেত্রকোণা ও ঢাকার জলবায়ু সংকটাপন্ন এলাকা থেকে এমন যুব তরুণ শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেন ৪ দিন ব্যাপি এক প্রায়োগিক যুব জলবায়ু কর্মশালায়। যুবদের প্রত্যেকেই নিজ এলাকায় যুব সংগঠনের মাধ্যমে জলবায়ু ও পরিবেশ সচেতনতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। শ্যামনগরের ‘সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের (এসএসএসটি)’ সদস্য রাইসুল ইসলাম নানা এলাকা থেকে আগত যুবদের নিয়ে গেলেন গাবুরার চকবারা গ্রামে। শ্যামনগরের ৬টি ইউনিয়নের ৬টি গ্রাম ও সাতক্ষীরা বনরেঞ্জে আয়োজিত এই কর্মশালায় শ্যামনগরের এসএসএসটি এবং সিডিওর যুব সংগঠকেরা ভিন্ন ভিন্ন এলাকার তরুণদের নিয়ে দলগতভাবে উপকূল ঘুরিয়ে দেখালেন। অংশগ্রহণকারীরা উপকূলের কৃষক, বনজীবী, জেলে, মুন্ডা-বাগদী, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষক, স্থানীয় সরকার, জনসংগঠন ও যুব প্রতিনিধিদের কাছ থেকে জানলেন জলবায়ু সংকট, দ্বন্দ্ব এবং টিকে থাকার কৌশলগুলো। নিজের চোখে দেখলেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং উপকূল মানুষের জীবনসংগ্রাম। ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে আগত তরুণেরা জানালেন, সব এলাকাতেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে এবং এ কারণে সবার জীবনে বাড়ছে সংকট। দেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের যুবরা উপকূল অঞ্চলের জলবায়ু সংকট এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামকে খুব কঠিন দু:সহ বাস্তবতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কর্মশালার অংশ হিসেবে যুবরা ‘সুন্দরবনকে প্লাস্টিক ও বিষমুক্ত রাখার দাবিতে’ মুন্সীগঞ্জ থেকে কলাগাছিয়া পর্যন্ত এক জলবায়ু প্রচারাভিযান আয়োজন করেন যুবরা। কাগজ ও কাপড়ে হাতে লেখা বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুনের মাধ্যমে যুবরা জানান, বিশ^ঐতিহ্য কেবল দুর্যোগ থেকে দেশকে বাঁচায় না বরং বিশে^ও এই বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন পৃথিবীর এক বৃহত কার্বণ শোষণাগার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা, জোয়ারের উচ্চতা এবং দুর্যোগ বৃব্ধির প্রভাব থেকে এই বনকে বাঁচাতে হবে পৃথিবীর টিকে থাকার স্বার্থে। দেশের সব তরুণ যুবদেরকেই সচেতনভাবে এই দায়িত্ব নিতে হবে। আটুলিয়ার বিড়ালাক্ষী, সদরের কালমেঘা, মুন্সিগঞ্জের মথুরাপুর, গাবুরার চকবারা, ঈশ^রীপুরের ধূমঘাট, বুড়িগোয়ালিনীর আশ্রয়নকেন্দ্র, পদ্মপুকুরের কামালকাঠি গ্রামে ঘুরে ঘুরে যুবরা জানতে পারেন ৪০ বছর আগে এলাকায় যেসব ধান, মাছ, গাছ, পাখি ও বন্যজীবজন্তু ছিল সেসব এখন হারিয়ে গেছে। যুবরা জানতে পেরেছেন এলাকার দুর্যোগ পঞ্জিকাও বদলে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক, কৃষি, স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং পানি সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন নানাধরণের পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। জলবায়ু সংকট সামাল দিয়ে জনগোষ্ঠী কিভাবে টিকে থাকছেন এবং অভিযোজনচর্চা করছেন সেসব বিষয় যুবদের উৎসাহিত করেছে। যুবরা তাদের অভিজ্ঞতাগুলো সমাপণী অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন। ২১ মার্চ বিশ^ বন দিবস এবং আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য দিবসের প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আয়োজিত কর্মশালার সমাপণীপর্বে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ডা. নিরাপদ বাইন, শ্যামনগর জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির আহবায়ক কৃষক সিরাজুল ইসলাম, আদিবাসী নেতা কৌশল্যা মুন্ডা, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদেও প্যানেল চেয়ারম্যান জিএম আব্দুর রউফ, উপকূলীয় প্রেসক্লাবের সভাপিত এম এ হালিম, বারসিকের নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেন, বারসিক নিউজডটকমের সম্পাদক সিলভানুস লামিন, নগরদারিদ্র্য গবেষক জাহাঙ্গীর আলম, বারসিক উপকূল সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোয়ারদার এবং বারসিকের বাবলু জোয়ারদার ও রুবিনা পারভীন সহ অনেকেই। সনদপত্র বিতরণ এবং সাংস্কৃতিক কর্মসূচির ভেতর দিয়ে কর্মশালার সফল সমাপ্তি ঘটে।
Leave a Reply