রাজশাহী প্রতিনিধিঃ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ১১ আবাসিক হলে গত কয়েক বছর ধরে আসন বরাদ্দ দেয় না রাবি কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ মাদারবক্স হলে নামমাত্র কয়েকটি সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তাও আবার বছর দুয়েক আগে। তবে হল কর্তৃপক্ষ ছিট বরাদ্দ না দিলেও থেমে নেই সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা। আবাসিক হলগুলোর প্রতিটিতেই ছাত্রলীগের কর্মী রাখার নামে বøক দখল করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সাধারণ ছাত্রদের তোলা হচ্ছে আবাসিক হলে। পরে সময় বুঝে ফাঁকা সিটে তাদের পাঠানো হয়। বøক দখল করে নীরব সিট বাণিজ্যে জড়িত হল শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা ও কমীরা।
রাবির হল শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রদের হলগুলোতে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারির নামে রয়েছে আলাদা বøক। সাংগঠনিক কাজ গতিশীল রাখতে এসব ব্লকে ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী রাখার অজুহাতে টাকার বিনিময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হলে তুলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এখানে থাকা অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই হল কার্ড নেই বলে জানা গেছে।
রাবি সূত্রে জানা যায়, গত ২ বছরে সর্বশেষ মাদারবক্স হলে নামমাত্র বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া আর কোনো হলেই সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
টাকা দিয়ে ছাত্রলীগের ব্লকে ওঠা কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, হলে তোলার নামে প্রথমে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়। পরে কিছুদিন থাকতে হয় ছাত্রলীগের এসব ব্লকে। ব্লকে থাকাকালীন ছাত্রলীগের মিটিং-মিছিলে যেতে বাধ্য করে। যদিও টাকা দিয়ে হলে ওঠায় এসব মিটিং মিছিলে যেতে বাধ্য নন তারা। তবে বলা যায় এক প্রকার চাপে পড়েই যেতে বাধ্য হয়। কিছুদিন সেখানে থাকার পর অন্য ব্লকে সিট ফাঁকা হলে তাদেরকে সেখানে পাঠানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা কর্মীরা জানান, তাদের একনিষ্ঠ অনেক ছাত্রলীগ কর্মী আছে যারা সংগঠনের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে। কিন্তু হলে তারা সিট পাচ্ছেন না। প্রতিটি হলে তাদের ছাত্র সংগঠনের জন্য থাকা ব্লকগুলোতে ৮-১০ হাজার টাকার বিনিময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে হলে তোলা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ১১ হলের মধ্যে ৫টির দেওয়ালে প্রকাশ্যেই ‘প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি ব্লক’ লেখা রয়েছে। আর বাকিগুলোর দেওয়ালে প্রকাশ্যে লেখা না থাকলেও সভাপতি-সেক্রেটারির ব্লক আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত রয়েছে।
টাকা দিয়ে ছাত্রলীগের ব্লকে ওঠা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী বলেন, হলে তুলে দেওয়ার কথা বলে সাত হাজার টাকা নেয় এক নেতা। তবে রুম দেওয়ার কথা বলে ছাত্রলীগের ব্লকে রাখে। প্রতিনিয়ত মিটিং মিছিলে জোর করেই নিয়ে যেত। ছয় মাস থাকার পর একটা ফাঁকা সিট পেয়ে সেখানে শিফট করে। ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম জানতে চাইলে বলতে আপত্তি জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী আমিনুল হক লিংকন বলেন, টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগের ব্লকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তোলার ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। বলা যেতে পারে এটা সংগঠনের জন্য অশনিসংকেত। ছাত্রলীগের বøক থাকা সত্বেও কর্মীরা হলের সিটে উঠতে পারছে না। এমন কর্মকাণ্ডে সংগঠনও প্রশ্নবিদ্ধ।
শহীদ জিয়াউর রহমান হলের দ্বিতীয় ব্লকের তৃতীয় তলার দেওয়ালে বড় করে লেখা রয়েছে ‘সেক্রেটারি ব্লক’। লেখার বিষয়ে জানতে চাইলে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন বলেন, আমি ব্লক দখল করেছি বিষয়টা এমন নয়। আমরা যারা ছাত্রলীগ করি সবাই পাশাপাশি থাকি। তাই অনেকে মনে করেন বøক দখল করে আছি। যেহেতু ব্লকে আমরা সবাই পাশাপাশি থাকি তাই সেক্রেটারি ব্লক লেখা হয়েছে।
ব্লকে ছাত্রলীগের কর্মী না তুলে টাকার বিনিময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তোলার বিষয়ে তিনি বলেন, যখন আমি একটা ব্লকে আছি তখন সেইটা আমার ব্লক নামে পরিচিত হয়ে যাচ্ছে। তবে কেউ যদি ব্লক দখল করে সিট বাণিজ্য করে সেটা অবশ্যই বড় ধরনের অপরাধ। তবে আমি এমন অপরাধে জড়িত নই।
ছাত্রলীগের কর্মী তোলার নামে সিট বাণিজ্যের বিষয়ে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সভাপতি চিরন্তন চন্দের কাছে জানতে চাইলে তিনি ১০ মিনিট পরে ফোন দেবেন বলে কেটে দেন। পরে আর ফোনে তাকে পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, চুপিসারে অনেকেই সিট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তবে এমন কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। যদি কারো বিরুদ্ধে তথ্য সহকারে প্রমাণ পাই তাহলে অবশ্যই দল থেকে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হলের ব্লক দখল করতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হল কারো বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়। হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবৈধভাবেই ব্লক দখল করে আছে। আমার হলের দেওয়ালেও সভাপতি-সেক্রেটারির নামে আলাদা ব্লক লেখা রয়েছে। ‘এসব ব্লকে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে আবাসিকতা প্রদান করা হলেও তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের উঠতে দেয় না। অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন, প্রভোস্ট, সোহরাওয়ার্দী হল এখানে যারা থাকে অধিকাংশই হলের অবৈধ শিক্ষার্থী। এসব ব্লকে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে আবাসিকতা প্রদান করা হলেও তারা তাদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে উঠতে দেওয়া হয় না। হল প্রশাসনও একরকম তাদের কাছে জিম্মি বলে জানান তিনি।
শহীদ শামসুজ্জোহা হলের প্রভোস্ট ড. মো: একরামুল ইসলাম বলেন, হলে ছাত্রলীগের আলাদা ব্লক বলতে কিছু নেই। কোনো সংগঠনের আলাদা ব্লক থাকাটা কাম্য নয়। হল সব শিক্ষার্থীদের জন্য সমান অধিকার। হলে যদি এমন কোনো পলিটিক্যাল ব্লক থাকে তাহলে অবশ্যই তা অপরাধ। অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা অভিযান চালাবো।
রাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, কোনো ছাত্র সংগঠনেরই হলে ব্লক দখল করে রাজনীতি করা যৌক্তিক নয়। এসব দখলকৃত ব্লক উদ্ধার করার জন্য আমরা হল প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামীতে আমরা হলে অভিযান চালিয়ে এসব সমস্যা সমাধান করবো।
সম্পাদকঃ এম এ হালিম, মোবাইল: ০১৯১১-৪৫১৬৯৭,০১৭৮১১৫৮৯২৯ , Email- halim.nildumur@gmail.com.